পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস সংগ্রাম, আত্মত্যাগ এবং ন্যায্য অধিকারের দাবিতে গড়ে ওঠা এক দীর্ঘ লড়াইয়ের ইতিহাস বটে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব ও মুখপাত্র হিসেবে সন্তু লারমা একসময় বৃহত্তর জনসমর্থন ও বিশ্বাস অর্জন করেছিলেন। কিন্তু গত তিন দশকে তাঁর রাজনৈতিক ভূমিকা এবং অবস্থান এই বিশ্বাসকে ক্রমশ প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
সন্তু লারমা বর্তমানে বাস্তবে আর জনগণের নেতা নন, বরং এক অভ্যন্তরীণ স্বৈরশাসক যিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর ছত্রছায়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেছেন। পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর থেকে তিনি যে রাজনীতির পথ ধরেছেন, তা মূলত শাসকগোষ্ঠীর দেওয়া সুবিধা ও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখারই একটি কৌশল। জনগণের ন্যায্য অধিকার, স্বশাসনের দাবি কিংবা প্রকৃত আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রাম—এসব প্রশ্নে তিনি প্রায় নীরব, নিষ্ক্রিয় অথবা কৌশলে এড়িয়ে চলেছেন।
তার নেতৃত্বাধীন জেএসএস (মূল) এখন আর গণতান্ত্রিক বা সংগ্রামশীল সংগঠন নয় বরং একটি প্রতিষ্ঠানগত শক্তি, যেটি প্রতিপক্ষ দল, নতুন প্রজন্মের আন্দোলনকারী এবং ভিন্নমতের নেতাকর্মীদের দমন ও নিপীড়নে সক্রিয়। এটি আন্দোলন নয়, বরং একটি অভ্যন্তরীণ আধিপত্যবাদ কায়েমের চেষ্টা, যা পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক পরিসরকে সংকুচিত করছে এবং নতুন নেতৃত্ব ও গণভিত্তিক সংগঠনের উত্থানকে রুদ্ধ করে দিচ্ছে।
এ অবস্থায় সন্তু লারমার পতন শুধু ব্যক্তিকেন্দ্রিক কোনো রাজনীতি পরিবর্তনের প্রশ্ন নয়, বরং এটি একটি অভ্যন্তরীণ ক্ষমতাকেন্দ্রিক স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসানের পূর্বশর্ত। যতক্ষণ পর্যন্ত এই একচেটিয়া নেতৃত্বের অবসান না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে গণভিত্তিক, অংশগ্রহণমূলক এবং বৈচিত্র্যসম্মত নতুন রাজনৈতিক আন্দোলনের বিকাশ সম্ভব নয়।
সুতরাং সন্তু লারমার পতন মানে কেবল একটি নেতৃত্বের পতন নয়—এটি একটি যুগপৎ প্রতীকী ও বাস্তব রাজনৈতিক রূপান্তরের আহ্বান। এটি পার্বত্য চট্টগ্রামে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ও জাতিসত্তাভিত্তিক রাজনীতির পথ প্রশস্ত করার একটি পূর্বশর্ত।