পার্বত্য চট্টগ্রামে সমতলের বাঙালিদের পুনর্বাসনের ইতিহাস একটি দুঃখজনক ও জটিল অধ্যায়, যা এখনো পাহাড় ও সমতলের জনগণের মধ্যে বিভেদ, অবিশ্বাস ও ক্ষোভ সৃষ্টি করে রেখেছে। ১৯৭৯ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সরকার একটি পরিকল্পিতভাবে সমতল থেকে বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এই প্রক্রিয়াটি ‘সেটেলমেন্ট প্রোগ্রাম’ নামে পরিচিত, যার মাধ্যমে কয়েক লক্ষ বাঙালিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে পুনর্বাসন করা হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে বলা হয়েছিল, এটা “অব্যবহৃত জমি” উন্নয়নের জন্য, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা ছিল পাহাড়িদের ঐতিহ্যগত বসতি ও জমি দখলের এক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ।
অনেক বাঙালি পরিবার শুরুতেই পাহাড়ে যেতে চায়নি। কারণ তারা জানত, পাহাড়ি এলাকা দুর্গম, জীবনযাপন কঠিন, পরিবেশ-প্রতিবেশ ভিন্ন এবং ভাষা ও সংস্কৃতির পার্থক্য অনেক। কিন্তু সরকার তাদের পাহাড়ে জমি, খাদ্যশস্য, গবাদি পশু, নগদ অর্থ ও বাসস্থান তৈরি করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রলুব্ধ করে। এই প্রতিশ্রুতিগুলো অনেক ক্ষেত্রেই কাগজে-কলমে থেকে যায়, বাস্তবে তার অনেকটাই পূরণ হয়নি।
তবে এর বাইরেও এক ভয়াবহ চিত্র ছিল—অনেক বাঙালিকে জোরপূর্বক পার্বত্য চট্টগ্রামে পাঠানো হয়। নির্দিষ্টভাবে কিছু এলাকাতে, সরকারি প্রশাসন ও সেনা বাহিনীর সহায়তায় সমতলের গরিব কৃষক ও ভূমিহীনদের বাড়ি থেকে ট্রাকে করে তোলা হয়, এবং পাহাড়ে নিয়ে পুনর্বাসন করা হয়। অনেকেই এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ ছিলেন। এখনো অনেক সেটেলার বাঙালি ভাই নিজেরাই বলেন, “আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে আসতে চাইনি, জিয়া সরকার জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছে।” এমনকি কেউ কেউ পালিয়ে সমতলে ফিরে আসতে চাইলে, তাদের আবার সেনাবাহিনীর সহায়তায় ধরে এনে পাহাড়ে ফিরিয়ে আনা হয়।
এই পুনর্বাসন পরিকল্পনার ফলে পাহাড়িদের হাজার হাজার একর জমি বাজেয়াপ্ত করা হয়। সরকারিভাবে বলা হয়েছিল, এই জমিগুলো পরিত্যক্ত ও ব্যবহারযোগ্য নয়, কিন্তু বাস্তবতা হলো—সেগুলো ছিল পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর পৈতৃক চাষাবাদযোগ্য জমি ও বসতি এলাকা। তাদের মতামত না নিয়ে এই ভূমিগুলো অধিগ্রহণ করে সেখানে সেটেলারদের বসানো হয়। সরকার প্রশাসনিকভাবে বাঙালি বসতি তৈরি করতে পাহাড়িদের উচ্ছেদ করে, এবং নতুন গ্রাম, স্কুল, বাজার গড়ে তোলে শুধুমাত্র বাঙালিদের জন্য।
এই প্রক্রিয়ায় সেটেলার বাঙালিদেরকে রাষ্ট্র একটি কৌশলগত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। তাদের সামনে “ভূমির অধিকার” ও “নতুন জীবনের প্রতিশ্রুতি” দেওয়া হলেও, মূল উদ্দেশ্য ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিগত ভারসাম্য পরিবর্তন করে পাহাড়িদের রাজনৈতিক দাবিকে দুর্বল করা। একদিকে বাঙালিরা হয়ে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত—ভূমিহীন মানুষ পাহাড়ে গিয়ে দারিদ্র্যের মুখে পড়ে, অন্যদিকে পাহাড়িরা হারায় নিজেদের জমি, সংস্কৃতি ও নিরাপত্তা।
অনেক সেটেলার পরিবার পরে নিজেরাই বুঝতে পারে, তারা এই পরিকল্পনার শিকার। একাধিক পরিবার, যারা বারবার পালিয়ে সমতলে ফিরতে চেয়েছে, তাদের সরকারি চাপ ও সেনাবাহিনীর ভয়ভীতি দেখিয়ে আবার পাহাড়ে পাঠানো হয়েছে। এই ভয়ানক বাস্তবতা শুধু পাহাড়িদের নয়, অনেক সেটেলার বাঙালির জন্যও ছিল বেদনার।
এই ইতিহাস প্রমাণ করে, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেটেলমেন্ট ছিল এক ধরনের দ্বৈত নিপীড়নের ফল—যেখানে রাষ্ট্র একদিকে পাহাড়িদের জমি কেড়ে নিয়েছে, অন্যদিকে দরিদ্র বাঙালিদেরকে ভুল স্বপ্ন দেখিয়ে বিপদে ফেলেছে। শান্তি চুক্তির পরও এই ভূমি দখল, জাতিগত বৈষম্য এবং নিরাপত্তাহীনতার পরিস্থিতি এখনো কাটেনি। যারা কখনোই পাহাড়ে যেতে চাননি, তারাও আজ সেখানে আটকে পড়া এক জনগোষ্ঠী—না পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য পাহাড়িদের কাছে, না-ই রাষ্ট্রের কাছে পূর্ণ সুরক্ষিত।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে প্রয়োজন খোলামেলা আলোচনা, ঐতিহাসিক সত্য স্বীকার, এবং ন্যায়ভিত্তিক ভূমি ও নাগরিক অধিকার পুনর্বিন্যাস। পার্বত্য চট্টগ্রামে টেকসই শান্তির জন্য প্রয়োজন পাহাড়ি ও সেটেলার বাঙালি উভয়ের অধিকারের সমতা এবং একটি মানবিক রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি।