জাতীয় সংসদে সংবিধানের বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাস হয় ২০১১ সালের ৩০ জুন। এই সংশোধনীর মাধ্যমে দেশের ভিন্ন ভাষাভাষী সংখ্যালঘু জাতিসত্তাসমূহের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় বাঙালি জাতীয়তাবাদ। আওয়ামী লীগ সরকার সংখ্যাগরিষ্টতার জোরে তড়িঘড়ি করে সংসদে উক্ত পঞ্চদশ সংশোধনী বিলটি পাস করে নেয়। এতে ৬ অনুচ্ছেদের (২)-এ বলা হয়েছে “বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিতি হইবেন”। যদিও কারা জনগণ আর কারা নাগরিক কিংবা জনগণ ও নাগরিকের মধ্যে পার্থক্য কী তার কোন ব্যাখ্যা সরকার দেয়নি।
পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে কার্যত দেশে বসবাসরত চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, খিয়াং, ম্রো, খুমি, তঞ্চঙ্গ্যা, বম, পাংখো, রাখাইন, সান্তাল, গারো, মনিপুরি, ওঁরাওসহ দেশে বসবাসরত ৪৫টির অধিক জাতিসত্তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে।
উক্ত বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের দাবিতে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশে ব্যাপক প্রতিবাদ, বিক্ষোভ হয়েছে। এখনো প্রতিবাদ চলমান রয়েছে। কিন্তু সংখ্যালঘু দরদী ভাণ করা আওয়ামী লীগ তার শাসনামলে এ সংশোধনী বাতিল বা সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।
চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলেও পঞ্চদশ সংশোধনীর উক্ত বিতর্কিত অনুচ্ছেদ/ধারা এখনো বাতিল করা হয়নি।
স্মর্তব্য যে, সংবিধানের এই পঞ্চদশ সংশোধনী আনয়নের জন্য তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার একটি কমিটি গঠন করেছিল। সংসদে আইনটি পাসের পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের কাছ থেকে মতামত গ্রহণ করে ইউপিডিএফ ২০১০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সংবিধান সংশোধনী কমিটির নিকট দেশের সকল জাতিসত্তার স্ব স্ব পরিচয়ে সাংবিধানিক স্বীকৃতি, পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল’ ঘোষণাসহ ৬ দফা সংশোধনী প্রস্তাবনা দিয়েছিল। এছাড়া বিভিন্ন সংগঠন ও দেশে বসবাসরত জাতিসত্তাসমূহের পক্ষ থেকেও নানা প্রস্তাবনা পেশ করা হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার এসব দাবি-দাওয়ার কোন গুরুত্ব না দিয়ে বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাস করে।
এখানে আরো উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মুলত বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে আওয়ামী লীগ এদেশে বসবাসরত বাঙালি ভিন্ন অন্য জাতিগুলোকে বাঙালি বানানোর প্রক্রিয়া শুরু করে। যার কারণে ১৯৭২ সালের সংবিধানেও বাংলাদেশের নাগরিকদেরকে “বাঙালি” হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের নেতৃবৃন্দ এর বিরুদ্ধে সে সময় সংসদের ভেতরে ও বাইরে তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন।
’৭২ সালের ৩১ অক্টোবর সংসদে খসড়া সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আব্দুর রাজ্জাক ভূঁইয়া বাঙালি জাতীয়তা অন্তর্ভুক্ত করে সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করলে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, “মাননীয় স্পীকার, আমি যে অঞ্চল থেকে এসেছি, সেই পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীরা যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশে বাস করে আসছে। বাংলাদেশের বাংলা ভাষা বাঙালিদের সঙ্গে আমরা লেখাপড়া শিখে আসছি। বাংলাদেশের সংগে আমরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সবদিক দিয়েই আমরা একসঙ্গে একযোগে বসবাস করে আসছি। কিন্তু আমি একজন চাকমা। আমার বাপ, দাদা চৌদ্দ পুরুষ-- কেউ বলে নাই, আমি বাঙালি। ...আমি জানি না, আজ আমাদের এই সংবিধানে আমাদেরকে কেন বাঙালি বলে পরিচিত করতে চায়’’।
এরপর স্পিকার তাঁকে ‘আপনি কি বাঙালি হতে চান না’? এমন প্রশ্ন করলে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা উত্তরে বলেছিলেন, ‘আমাদেরকে বাঙালি জাতি বলে কখনও বলা হয় নাই। আমরা কোনো দিনই নিজেদেরকে বাঙালি বলে মনে করি নাই। আজ যদি এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সংবিধানের জন্য এই সংশোধনী পাশ হয়ে যায়, তাহলে আমাদের এই চাকমা জাতির অস্তিত্ব লোপ পেয়ে যাবে। আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। আমরা আমাদেরকে বাংলাদেশী বলে মনে করি। কিন্তু বাঙালি বলে নয়”।
কিন্তু সংখ্যাগরিষ্টতার জোরে সেদিন সংসদে “বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবেন’ এই প্রস্তাবটি সংসদে পাস করা হলে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তা প্রত্যাখ্যান করে প্রতিবাদস্বরূপ সংসদ কক্ষ থেকে বের হয়ে যান। বাঙালি জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে তিনি ’৭২-এ সংসদে গৃহিত সংবিধান আইনে স্বাক্ষর করেননি বলেও জানা যায়।
পরবর্তীতে ক্ষমতার পালাবদল ঘটলে বিএনপি ক্ষমতায় এসে সংবিধান থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ রহিত করে তার পরিবর্তে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু তারাও দেশের সংখ্যালঘু জাতিসমূহুকে সাংবিধানিক স্বীকতি দেয়নি।
এরপর ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ ’৭২ এর সংবিধান পুনঃপ্রবর্তনের কথা বলে সংখ্যাগরিষ্টতার জোরে সংসদে ‘পঞ্চদশ সংশোধনী’ বিল পাস করে পূনরায় সংবিধানে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ অন্তর্ভুক্ত করে। এতে দেখা গেল, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা এর প্রতিবাদ তো করেনই নি, বরং টেবিল চাপড়িয়ে এর সমর্থন দিয়েছেন। যে দলিলে তাদেরকে ও তাদের নিজ নিজ জাতির জনগণকে বাঙালি বলে হেয় ও অবজ্ঞা করা হয়েছে সে দলিলে তারা বিনা দ্বিধায় স্বাক্ষর করেছেন! এটা জাতির জন্য বড়ই লজ্জার।
বাঙালি জাতীয়তা চাপিয়ে দেওয়া এই পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের দাবি জানিয়ে ইউপিডিএফের নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ লাল পতাকা মিছিল, তিন জেলা জুড়ে সর্ববৃহৎ ও দীর্ঘ গণ-মানববন্ধন, বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ, লাল কার্ড প্রদর্শন--ইত্যাদি নানা কর্মসূচি পালন করেছে এবং এখনো এ দাবিতে সোচ্চার রয়েছে।
বিতর্কিত এই পঞ্চদশ সংশোধনীর ক্ষমতাবলে শাসকগোষ্ঠি ধর্মীয় ও ভিন্ন ভাষাভাষী সংখ্যালঘু জাতিগুলোকে বাঙালি বানানোর প্রক্রিয়া এখনো জারি রেখেছে। বিভিন্ন সরকারি চিঠিপত্র ও দলিলে জাতিসত্তার প্রতিনিধিদেরকে ‘জনাব’, ‘বেগম’ এমনকি ২০২২ সালে রাঙামাটির লংগদু থানা পুলিশের এক এএসআই কর্তৃক চাকমা সম্প্রদায়ের এক বাদিকে ”মো.” সম্বোধন করে নোটিশ জারি করা হয়েছিল। যদিও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের আপত্তির মুখে তিনি এর জন্য ভুল স্বীকার করেছিলেন।
শুধু তাই নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গার নামেও আনা হচ্ছে পরিবর্তন। পাহাড়িদের আদি নাম বাদ দিয়ে তার পরিবর্তে ইসলামী নাম বসিয়ে সাইনবোর্ড লাগানো হচ্ছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর বিতর্কিত অনুচ্ছেদ ও সংবিধানের মূলনীতিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বহাল থাকলে ভবিষ্যতে এই বাঙালি বানানোর প্রক্রিয়া যে আরো জোরদার করা হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
এখানে আরো যে বিষয়টি বলা দরকার সেটি হচ্ছে, চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের হাইকোর্ট পঞ্চদশ সংশোধনীর কয়েকটি ধারা বাতিল ঘোষণা করলেও বাঙালি জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দেয়ার বিষয়টি বাতিল করেনি।
অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করলেও সংবিধান থেকে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের চাপিয়ে দেওয়া বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিষয়ে এখনো কোন সিদ্ধান্ত জানাতে পারেনি। উপরন্তু আগামীতে ক্ষমতা প্রত্যাশী বড় দলগুলো কমিশনের সুপারিশে উল্লেখিত ‘বহুত্ববাদ” শব্দটিও মেনে নেয়নি বলে গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরও যদি দেশের সংবিধানকে প্রকৃত গণতান্ত্রিক সংবিধানে পরিণত করা না হয় এবং এদেশের বাঙালি ভিন্ন অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিসমূহকে সংবিধানে স্বীকৃতি দেওয়া না হয়, তাহলে বাংলাদেশ কখনো একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারবে না।
কাজেই, বর্তমান অন্তর্বতী সরকার ও সংবিধান সংস্কার কমিশনের উচিত হবে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া এবং পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের সংখ্যালঘু জাতিসত্তাসমূহকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানপূর্বক বাঙালি জাতীয়তাবাদ সংবিধান থেকে রহিত করা।
আর পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের জাতিসত্তাগুলোর উচিত হবে সংবিধানে চাপিয়ে দেওয়া বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে সোচ্চার হওয়া।