কোনো অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসন ঘোষণা হলেই তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী হয়ে যায় না বলে মন্তব্য করেছেন দীর্ঘ ৫ বছর ‘আয়নাঘরে’ বন্দি থাকা ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) নেতা মাইকেল চাকমা। তিনি বলেন, ‘আমরা সামরিক বাহিনির নির্যাতন নিরসনে স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিলাম। তখন থেকে আমাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী ট্যাগ দেওয়া হচ্ছে।’
আজ শুক্রবার ‘জুলাই গণঅভ্যূথানের এক বছর: পাহাড়-সমতলের জাতিসত্তাসমূহের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় তিনি এ সব কথা বলেন। এ দিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিন্স কমপ্লেক্সের সম্মেলন কক্ষে আলোচনা সভাটির আয়োজন করে শাখা বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)।
এ সময় চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী মিশুক চাকমার সঞ্চালনায় সভায় আরও বক্তব্য রাখেন পিসিপি কেন্দ্রীয় সভাপতি অমল ত্রিপুরা, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী রাবি শাখার সাবেক সভাপতি প্রদীপ মারদী, ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক গোলাম সরোয়ার সুজন, ছাত্র ইউনিয়নের রাবি সংসদের সভাপতি (একাংশ) রাকিব হোসেন, ছাত্র ফেডারেশনের যুগ্ম আহ্বায়ক আজাদ ইসলাম, রাষ্ট্রচিন্তার কৌশিক দাস কঙ্কন ও ছাত্র গণ-মঞ্চের আহ্বায়ক নাসিম সরকার।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সমালোচনা করে মাইকেল চাকমা বলেন, ‘সমতলে ফ্যাসিবাদেও নানান চিহ্ন মুছে দেওয়ার অন্তত চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু পাহাড়ের সামরিক শাসনের অবসান ঘটেনি। পাহাড়ে শান্তি চুক্তিটি আছে, তা দিয়ে শান্তি কতটুকু আসবে জানা নেই। তবু প্রশ্ন থাকে সে চুক্তি অনুযায়ীও কোনো কাজ হয়েছে কিনা। এমনকি হাসিনা আমলের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ১১ দফা গোপন নির্দেশনা এখনও বহাল রাখা হয়েছে।
পাহাড়িদের ২৪’র কোনো প্রত্যাশা বাস্তবায়ন হয়নি দাবি করে তিনি বলেন, আমাদের প্রত্যাশা ছিলো, ‘২৪’র অভ্যূথানের পরে আমাদের অনেক আশা বাস্তবায়ন হবে। কারণ এই সরকারের উপদেষ্টারা মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেছেন। প্রধান উপদেষ্টা নিজেই নোবেল বিজয়ী। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি শূন্য। এখনো পাহাড়ে সেনা বাহিনীর গুলিতে মানুষ মারা যায়। এক বছর আগে রুবেল ত্রিপুরাকে সেনাবাহিনী গুলি করে মারে। এ ঘটনায় একজন উপদেষ্টা সেখানে সফরেও যান এবং বিচারের বিষয়ে আশ্বস্ত করেন। তবে এক বছর হলেও সে তদন্ত কমিটির ফলাফল প্রকাশ করা হয়নি। মানবাধিকার লঙ্ঘন এখনও অব্যাহত রয়েছে।
পাহাড়ে সেনা শাসনের বর্নণা দিয়ে তিনি বলেন, ‘পাহাড়ে অস্ত্র উদ্ধার মানেই নাটকের মঞ্চায়ন। এখানে সামরিক শক্তি ধারাবাহিকভাবে এই নাটক মঞ্চায়ন করে। মানুষের মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারায় পাহাড়িদের সম্পর্কে নেতিবাচকতা ছড়িয়ে দিতে তারা আগেই পরিকল্পনা করে এই কাজ করে।’
এ সময় বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী রাবি শাখার সাবেক সভাপতি প্রদীপ মারদী বলেন, ‘পাহাড়িদের প্রাপ্তির প্রশ্নটা ৫০ বছরে প্রশ্ন হয়েই থেকছে। রাষ্ট্রের ক্ষমতার পরিবর্তন হলেও তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। কোনো রাজনৈতিক দল, প্রতিষ্ঠান কেউ-ই বহু জাতিত্ব স্বীকার করেনি। বাংলাদেশ বহুজাতির হলে রাষ্ট্রব্যবস্থায়ও তার উপস্থিতি থাকতে হবে। রাষ্ট্রকাঠামোতেও আমরা চাই আদিবাসিদের সম্মানজনক অন্তর্ভুক্তি। তারা নিজেদেও ‘আদিবাসি’ বা অন্য কিছু বলে ডাকবে সে স্বাধীনতা তাদেরকেই দিতে হবে।’
ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক গোলাম সরোয়ার সুজন বলেন, ‘এ দেশে বারবার পাহাড়ীদের অধিকার সংকুচিত করা হয়েছে। আদিবাসীরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রথম বিরোধীতা শুরু করেছে। এর ধারাবাহিকতায় ৬৯, ৭১, ২৪’র গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে তারা উল্লেখযোগ্য ভুমিকা পালন করেছে। কিন্তু তাদেও প্রাপ্তির জায়গা হচ্ছে, শূন্য। উত্তরবঙ্গে দেখা যায় আদিবাসীরা ভুমি হারাচ্ছে, দখলদারিত্বের শিকার হয়ে উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতাবানরা ড্রয়িংরুমের সোফা, আসবাবপত্র বানাতে পাহাড়ের গাছ কেটে আনছে, কোটিপতিরা রাবার বাগান দখল দিচ্ছে। এতে আদিবাসীরা তাদের সম্পদ ও অধিকার হারাচ্ছে। ২৪-এ যে সুযোগ তৈরী হয়েছিল পূর্বের মতোই এবারেও তা বেহাত হয়ে যাচ্ছে।
শাখা বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) সাধারণ সম্পাদক শামিন ত্রিপুরার সভাপতিত্বে সভায় বিভিন্ন বিভাগ ও ইন্সটিটিউটের অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন।