চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে রাঙ্গুনিয়ার রাজা নগর একসময় ছিল চাকমা রাজাদের রাজধানী। সপ্তদশ শতাব্দীর নবাবী আমলে এখানে রাজপ্রাসাদ, রাজদরবার, হাতি-ঘোড়ার পিলখানা, বিখ্যাত সাগরদিঘী, দালান কৌটা, বৌদ্ধ-বিহারসহ অসংখ্য স্থাপত্য নির্মিত হয়। আজও ইট-সুরকির প্রাচীর, দুই হাতেরও বেশি পুরু দেয়াল এবং লতা-গুল্মে আচ্ছাদিত ভগ্নপ্রাসাদ নীরবে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সেরমুস্ত খাঁর আমল
চাকমা রাজত্বের গোড়া পত্তন হয় সেরমুস্ত খাঁর সময়ে (প্রায় ১৭৩৭ খ্রিঃ)। তাঁর রাজধানী প্রথমে ছিল বান্দরবানের আলীকদমে, পরে রাঙ্গুনিয়ার শিলক নদীর তীরে। তিনি আরাকানীদের অত্যাচারে মোঘল নবাব জুনকদর খাঁর সাথে সন্ধি করেন। দীর্ঘ প্রায় একশ বছর তিনি রাজত্ব করেন এবং ১৭৫৮ খ্রিঃ মৃত্যুবরণ করেন।
সুকদেব রায় ও রাজধানী স্থানান্তর
সেরমুস্ত খাঁর পালকপুত্র সুকদেব রায় রাজার আসনে বসেন। তিনি রাঙ্গুনিয়ার শিলক নদীর তীরে নতুন রাজধানী গড়ে তোলেন, যেটি “রাজা নগর” নামে পরিচিতি পায়। তাঁর স্ত্রী ছেলেমার স্মৃতিতে রাজপ্রাসাদের পাশে খনন করা হয় বিখ্যাত ছেলেমা পুকুর।
জান বক্স খাঁ ও উত্তরসূরিরা
সুকদেব রায়ের মৃত্যুর পর শের দৌলত খাঁ, এবং পরে তাঁর ছেলে জান বক্স খাঁ (১৭৮২ খ্রিঃ) রাজ্যভার গ্রহণ করেন।
দীর্ঘ ১৭ বছর রাজত্ব শেষে জান বক্স খাঁ রাজধানী স্থানান্তর করে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজা নগরকে চাকমা রাজধানী করেন।
তাঁর উত্তরসূরিরা ছিলেন টবর খাঁ, জবর খাঁ এবং ধরম বক্স খাঁ।
রানী কালিন্দী দেবীর শাসনকাল (১৮৩২–১৮৬৩)
ধরম বক্স খাঁর মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠা স্ত্রী রানী কালিন্দী দেবী রাজ্যভার গ্রহণ করেন।
তাঁর শাসনকাল ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যঃ
প্রশাসনে ইংরেজি ভাষা চালু করেন (ফরাসি ভাষার পরিবর্তে)।
বৌদ্ধ বিহারসহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণে সহায়তা করেন।
কুকি সম্প্রদায়ের লুটপাট দমন করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন।
শিলক ফজু দীঘির যুদ্ধে ব্রিটিশ সৈন্যদের পরাজিত করেন।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় বিদ্রোহীদের পাকড়াও করে ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেন, ফলে ব্রিটিশ শাসকরা তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হন।
এর ফলশ্রুতিতে ১৮৬০ সালে বার্ষিক জলকর কমিয়ে দেন।
তবে তিনি ব্রিটিশদের অন্যায় নীতির বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ করেছিলেন। প্রশাসক টমাস হাবার্ট লুইনের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তিনি জোরালো অবস্থান নেন।
ঐতিহ্যের অবক্ষয়
আজ এই ঐতিহাসিক রাজপ্রাসাদ সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে। স্থানীয় জনগণ, সরকার ও সংরক্ষণ বিভাগের উদ্যোগে এটি পুনরুদ্ধার করা গেলে রাজা নগর কেবল চট্টগ্রামের নয়, বরং সারা দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।