অন্তর্বর্তী সরকারকে নিয়ে ইউপিডিএফ এর হতাশা
“গণঅভ্যুত্থানের পর রাঙামাটি এবং খাগড়াছড়িতে যে ঘটনা ঘটেছে, হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, এটা কখনো প্রত্যাশিত ছিল না।”
রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে এসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রমের সমালোচনা করার পাশাপাশি হতাশা প্রকাশ করেছে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-ইউপিডিএফ।
পার্বত্য চট্টগ্রামভিত্তিক এ সংগঠনের সংগঠক মাইকেল চাকমা বলেছেন, গণঅভ্যুত্থানের পরও পাহাড়ে যা ঘটেছে, তা কখনো ‘প্রত্যাশিত ছিল না’।
শনিবার জাতীয় সংসদের এলডি হলে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে ইউপিডিএফের সংলাপে নেতৃত্ব দেন মাইকেল চাকম।
তিনি বলেন, ইউপিডিএফ সব সময় ‘গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার’ ওপর শ্রদ্ধাশীল, একটি ‘মানবিক কল্যাণকর অন্তর্ভুক্তিমূলক’ রাষ্ট্র কায়েই তাদের লক্ষ্য।
“সেই লক্ষ্যে ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে, এই সরকারের কাছ থেকে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ অনেক কিছু আশা করেছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম, অতীতে যে সমস্ত দমন পীড়ন চলে আসছিল, সেই দমন পীড়নের কিছুটা হলেও অবসান হবে এবং এই নতুন বাংলাদেশে আমরা আমাদের অধিকার নিয়ে পার্বত্য
চুরির অভিযোগে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় গতবছর সেপ্টেম্বরের ১৯ ও ২০ তারিখ খাগড়াছড়ির দীঘিনালা এবং রাঙামাটি শহরে ‘পাহাড়ি ও বাঙালিদের’ মধ্যে সংঘর্ষে চারজন নিহত হন, দুই দিনে ব্যাপক হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ চলে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ১৪৪ ধারা জারি করে স্থানীয় প্রশাসন।
মাইকেল চাকমা বলেন, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল, সেই তদন্ত কমিটি এখনো প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি।
“কারা সেই হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল, তা জানতে পারলাম না। তাছাড়া এখন পর্যন্ত পার্বত্য চট্রগ্রামে যে অবস্থা রয়েছে, সেই ক্ষেত্র বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যে কার্যক্রম, এর প্রতি আমরা কিছুটা হতাশা ব্যক্ত করতেই পারি।”
অতীতের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশের সবার জন্য মঙ্গলজনক পদক্ষেপ গ্রহণ করে একটি ‘সুখী সমৃদ্ধশালী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক’ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নের কথা বলেন এই ইউপিডিএফ নেতা।
মাইকেল চাকমা বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়িত জাতি ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা আন্দোলন সংগ্রাম করে যাচ্ছি। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানেও আমাদের দল অংশগ্রহণ করে। আমাদের সংগঠন শুরু থেকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, নিপীড়নের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে।
“যে অন্যায় শাসন পার্বত্য চট্টগ্রামে চলেছে, তার অবসানের লক্ষ্যে, এই বাংলাদেশকে বহুজাতির বহু ভাষার একটি বৈচিত্র্যময় দেশ হিসেবে যাতে প্রতিষ্ঠা করা যায়, সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।”
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশের সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে ইউপিডিএফ ‘অনেক বেশি’ নিপীড়নের শিকার হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
মাইকেল চাকমা বলেন, “আমরা চেয়েছিলাম এই বাংলাদেশ একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক দেশ হোক, এই দেশে সকল ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল জাতি সত্তার মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজের রাজনৈতিক অধিকার, ভাষা সংস্কৃতির অধিকার ভোগ করুক।
“কিন্তু বিগত সময়ে ইউপিডিএফের উপরে যেভাবে দমন-পীড়ন চালানো হয়েছিল, ইউপিডিএফ সেই রেজিমের প্রতি প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে।”
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে পার্বত চট্টগামের ২৭টি ভোটকেন্দ্রে শূন্য ভোট পড়ার কথা তুলে ধরে এই ইউপিডিএফ নেতা বলেন, “এর মধ্য দিয়ে সেই রেজিমের পতনের সূচনা শুরু হয়। সেই রায় ছিল গণরায়, ইউপিডিএফের নেতৃত্বে জনগণ লালকার্ড দেখিয়েছিল। সেই লালকার্ড দেখানো থেকে শুরু করে, সর্বশেষ ছাত্র জনতার প্রতিবাদ প্রতিরোধ উত্থান হয়, সবশেষ শেখ হাসিনাকে দেশ ছাড়তে হয়।”
রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর একীভূত সুপারিশ চূড়ান্ত করার পাশাপাশি এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য তৈরির জন্য কাজ করছে ঐকমত্য কমিশন।
পাঁচটি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশের ওপর ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মতামত জানতে চেয়েছিল ঐকমত্য কমিশন। এরপর সেই মতামত ধরে সংশ্লিষ্ট দলের সঙ্গে সংলাপ চলছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় এদিন আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য সফর রাজ হোসেন, বদিউল আলম মজুমদার, মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া।
মাইকেল চাকমার নেতৃত্বে ইউপিডিএফ প্রতিনিধি দলে ছিলেন বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদে কেন্দ্রীয় সভাপতি অমল ত্রিপুরা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও ইউপিডিএফের সদস্য জিকো ত্রিপুরা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাবেক সভাপতি ও ইউপিডিএফ সদস্য সুনয়ন চাকমা।
সংলাপের শুরুতে আলী রীয়াজ বলেন, “একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রই কেবল সকলের অধিকারকে নিশ্চিত করতে পারে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে। বিকেন্দ্রিত বিচার বিভাগের মধ্য দিয়ে প্রত্যেকটা মানুষের ঘরের দরজায় সুবিচারের ব্যবস্থা করতে পারে।
“জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সকলের সঙ্গে আলোচনা করে জাতীয় সনদ তৈরি করার জন্য সচেষ্ট আছে। তাতে আশা করছি সব ধরনের নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত করতে পারবে। সেই সুরক্ষা ছাড়া গণতান্ত্রিক সমাজ, রাষ্ট্র, নাগরিকদের মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।”
তিনি বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে আমরা যেন সকল নাগরিক মিলে, সকল ধরনের মত মিলে একটি সুনির্দিষ্ট পথ তৈরি করতে পারি। এটা একটা ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যা তৈরি হয়েছে বহু প্রাণের বিনিময়। এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারর মত পেয়েছি, যে সুযোগ, এই মুহূর্তকে প্রকৃত পক্ষে সফল করে তোলার জন্য আমাদের সকলকে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে।
“আশা করছি বাংলাদেশের সমস্ত নাগরিক, রাজনৈতিক দল এই আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে অগ্রসর হবে। রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে, এমন এক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যেখানে নাগরিক যেন মনে না করেন তার অধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে, তার নাগরিক অধিকারকে সুরক্ষার করবার প্রতিষ্ঠান থাকে। সেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, যে রাষ্ট্র মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করে, সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করে, সকলের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠা করে, সেই লক্ষ্যে আমরা সকলেই কাজ করার চেষ্টা করছি।”
আলী রীয়াজ বলেন, “নিঃসন্দেহে ইউপিডিএফ একটি ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত রাজনৈতিক দল। তারা নাগরিকদের অধিকার আদায়ে দীর্ঘদিন সংগ্রামে লিপ্ত আছে, সক্রিয় থেকেছে। আপনারা বিভিন্নভাবে নির্যাতিতও হয়েছেন, অধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। আপনাদের রাজনৈতিক অবস্থানের ভিন্নতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার আদর্শ-সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা, সে বিষয়ে অবিচল অঙ্গীকর লক্ষ্য করেছ।