চাকসু গঠনতন্ত্র প্রস্তাবনা নিয়ে পাহাড় ও সমতলের ক্রিয়াশীল আদিবাসী ছাত্র সংগঠনসমূহের সংবাদ সম্মেলন ও প্রস্তাবনা পেশ
চাকুস’তে আদিবাসী বা সংখ্যালঘু জাতিসত্তা বিষয়ক সম্পাদক পদ অন্তর্ভুক্তির দাবি
আজ ২৬মে ২০২৫ রোজ সোমবার দুপুর ০১ ঘটিকায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকসু ভবনের সামনে সংবাদ সম্মেলন করেছে পাহাড় ও সমতলের ক্রিয়াশীল আদিবাসী ছাত্র সংগঠনসমূহ।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য বলা হয়,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ। ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছিল প্রগতিশীল, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এবং দেশের প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সর্বশেষ ২৪’ এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে এই বিশ্ববিদ্যালয় নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শহীদ ফরহাদ হোসেন ও শহীদ হৃদয় চন্দ্র তরুয়া শহীদ হয়েছেন। জুলাই আন্দোলনের ০৯ দফার মধ্যে অন্যতম দফা ছিল দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ ও ছাত্রসংসদ চালু করা। গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচন হওয়া জরুরি বলে আমরা মনে করি।
আরো বলা হয়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পর্যন্ত মোট ০৫ বার ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে। সর্বশেষ, ১৯৯০ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ ৩৫ বছর পরে চাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাকসু নীতিমালা প্রণয়ন কমিটি করেছে। এই কমিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠন এবং শিক্ষার্থীদের নিয়ে ইতিমধ্যে ০২ বার বৈঠক করেছে। উক্ত বৈঠকগুলোতে আমরা মৌখিক কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরেছিলাম। আমরা পাহাড় ও সমতলের ক্রিয়াশীল আদিবাসী ছাত্রসংগঠনসমূহ নিম্নোক্ত লিখিত প্রস্তাবনা তুলে ধরছি:
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বহু জাতি, বহু ভাষা, ধর্ম ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যপূর্ণ একটি বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পাহাড় ও সমতলের প্রায় ১৫’টির অধিক বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত রয়েছে যাঁর সংখ্যা প্রায় ৭’শ অধিক। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান ও আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটসহ কিছু বিশেষায়িত বিভাগ রয়েছে। জাতিগোষ্ঠীসমূহের শিক্ষার্থীদের অধিকার, ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ, সংরক্ষণ ও গবেষণায় চাকসু হতে পারে শিক্ষার্থীদের অন্যতম প্ল্যাটফর্ম। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী কিংবা পিছিয়ে পড়া অঞ্চল থেকে সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রতিনিধিত্বের সুযোগ রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের সমান অবস্থান ও মর্যাদা নিশ্চিত করবে। যা অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম সৌন্দর্য। দেশের ‘সেকেন্ড পার্লামেন্ট’ খ্যাত ছাত্র সংসদ এক্ষেত্রে একটা বড় উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে। বর্তমান চাকসু গঠনতন্ত্র নিয়ে কিছু প্রস্তাবনা আমরা তুলে ধরছি:
প্রস্তাবিত পদ ও কাজের পরিধি সমূহ:
১. পরিবহন ও আবাসন বিষয়ক সম্পাদক
যৌক্তিকতা:
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের একমাত্র বাহন শাটল ট্রেন। শাটলে বগি বৃদ্ধি, নিরাপত্তা, সিট নিশ্চিতকরণ এবং ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে চক্রাকার বাস চালুসহ পরিবহণ সমস্যা সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ও শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতে কাজ করবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৭৩ অনুযায়ী এই বিশ্ববিদ্যালয় সম্পূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার কথা। অথচ ৮৫% শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে মেসে বা কটেজে এবং শহর থেকে যাতায়াত করে। শিক্ষার্থীদের আবাসন নিশ্চিতকরণ এবং হলগুলোতে বৈধভাবে সিট নিশ্চিতকরণেও হল ছাত্র সংসদ ও প্রশাসনের সাথে এই সম্পাদক কাজ করবে।
২. নারী বিষয়ক সম্পাদক
যৌক্তিকতা:
বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেলে অর্ন্তর্ভুক্ত হয়ে সেলের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ, স্বচ্ছতা ও ন্যায্য বিচার নিশ্চিতে কাজ করবে। নারী শিক্ষার্থীদের সাইবার বুলিং কিংবা হেনস্তার আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে এবং ব্যাক্তি স্বাধীনতা ও পোশাকের স্বাধীনতা নিশ্চিতে কাজ করবে। এছাড়াও নারী হল, অনুষদে নারীদের ঋতুস্রাবকালীন, মাতৃত্বকালীন ও স্বাস্থ্যগত জটিলতা নিরসন ও সমঅধিকার নিশ্চিতকরণে কাজ করবে।
৩. আদিবাসী বা সংখ্যালঘু জাতিসত্তা বিষয়ক সম্পাদক
যৌক্তিকতা:
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৭’শ অধিক বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত রয়েছে। বহু ভাষা, জাতি, ধর্মে ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যপূর্ণ ক্যাম্পাস আর দেশে কোথাও নেই। পিছিয়ে পড়া এবং সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের অধিকার সুনিশ্চিতকরণ, ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চা, গবেষণা নিশ্চিতকরণে এই সম্পাদক পিছিয়ে পড়া জাতিগোষ্ঠী থেকে নির্বাচিত হবে। রেসিজম, বুলিং প্রতিরোধসহ বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তি ও সম্প্রীতির পরিবেশ বজায় রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ ও সমন্বয় করবে। এছাড়াও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি যা এদেশের সম্পদ তা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে তুলে ধরবে। ৭৩’এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী সিনেটে যে ০৫ জন ছাত্র প্রতিনিধি থাকবে তাঁর মধ্যে পিছিয়ে পড়া জাতিগোষ্ঠীর এই সম্পাদক প্রতিনিধি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
যৌক্তিকতা:
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারকে অত্যাধুনিক হসপিটালে পরিণত করা এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতে এই সম্পাদক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাথে কাজ করবে। শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য বিমা চালু নিশ্চিত করবে।
৫. হল ছাত্র সংসদ বিষয়ে (অতীশ দীপংকর হল ও নবাব ফয়জুন্নেসা হল ছাত্র সংসদ নিয়ে)
যৌক্তিকতা: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান হল এবং নবাব ফয়জুন্নেসা হলে সংখ্যালঘু জাতিসত্তার শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি থাকে যা হলের মোট সিটের প্রায় অর্ধেক। এসব হলে সংসদ নির্বাচন হলে ভিপি অথবা জিএস যেকোন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে তাঁদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা।
অন্যান্য প্রস্তাবনা:
১) অনুচ্ছেদ ০২ অনুযায়ী চাকসু’র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট হওয়া উচিত। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে, বিশ্ববিদ্যালয় সকল শিক্ষার্থীর সমান সুযোগ ও অধিকার নিশ্চিত করা, সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষণ, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্পর্কের উন্নতি এবং শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে একটি চাপ প্রয়োগকারী সংস্থা এবং রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন নীতির সমালোচনা ও নাগরিক অধিকার চর্চার একটি মুখপাত্র হয়ে উঠা উচিত।
২) অনুচ্ছেদ ০৭ অনুযায়ী ছাত্র সংসদের সভাপতি ভিসিকে অতিরিক্ত ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের ভোটে সরাসরি নির্বাচিত কার্যনির্বাহী কমিটি’র চেয়ে ভিসির ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ‘চেক এন্ড ব্যালেন্স’ হওয়া উচিত। যেমন: চাকসু নির্বাহী কমিটির সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা বাতিল কমিটি সদস্যদের ‘দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে নির্ধারণ হওয়া উচিত। এবং উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চাকসু ভেঙে দেওয়ার সর্বময় ক্ষমতা ভিসির হাতে না থেকে নির্বাহী কমিটি’র হাতে থাকা উচিত।
সংবাদ সম্মলনে পাহাড় ও সমতলের বিভিন্ন ক্রিয়াশীল আদিবাসী ছাত্র সংগঠনসমূহের পক্ষে উপস্থিত ছিল:
১. সাথোয়াই অং মারমা, সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিল(বিএমএসসি), চবি শাখা
২. ধন রঞ্জন ত্রিপুরা, সভাপতি, ত্রিপুরা স্টুডেন্ট’স ফোরাম, চট্টগ্রাম মহানগর
৩. রোনাল চাকমা, সভাপতি, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, চবি শাখা
৪. সিংয়ইপ্রু শারমা, সাধারণ সম্পাদক, সাংস্কৃতিক কমিটি, বিএমএসসি
৫. পিযুষ টপ্য, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, ওঁরাও জনগোষ্ঠী প্রতিনিধি
৬. সিনেট চাকমা, ইংরেজি বিভাগ (২০২৩-২০২৪ সেশন)
সংবাদ সম্মেলন শেষে বিকাল ২:৩০টা ঘটিকায় চাকসু গঠনতন্ত্র প্রস্তাবনা ফাইল আকারে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপ-উপাচার্য(প্রশাসন) ও চাকসু নীতিমালা কমিটির প্রধান জনাব ড. কামাল উদ্দিনকে তুলে দেয়া হয়।
বার্তা প্রেরক
ভুবন চাকমা
সাধারণ সম্পাদক
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা
মোবা: ০১৫১৮-৩৫৫৩৫৪