ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের যতনবাড়ি টাউন হলে গতকাল এক প্রতিবাদ সভায় ‘ত্রিপুরা চাকমা গাবুজ্জে জোদা’ সংগঠন বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে পালিয়ে আসা জেএসএস (সন্তু লারমা গ্রুপ)-এর নানা অপকর্মের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করে। সভায় বক্তারা জেএসএস (সন্তু)-এর সন্ত্রাসী কার্যক্রম, অবৈধ মাদক ব্যবসা, মানবপাচার, অস্ত্র চোরাচালান ও সমাজবিরোধী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
প্রতিবাদ সভায় চাকমা সমাজের বিশিষ্টজন, যুব প্রতিনিধি এবং নারী সংগঠনের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। বক্তারা বলেন, “জেএসএস (সন্তু) বাহিনী শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামে নয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামেও অবৈধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে শুধু চাকমা সমাজ নয়, গোটা জাতিগোষ্ঠীর ভাবমূর্তি কলঙ্কিত হচ্ছে।”
সভায় উল্লেখ করা হয়, গত ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ সালে আগরতলার বাঁধাঘাট এলাকা থেকে অস্ত্র ও বিদেশি মুদ্রা,অবৈধ পাসপোর্ট ও মানব পাচারের অভিযোগে জেএসএস সদস্য সমাজপ্রিয় চাকমাকে গ্রেফতার করে আগরতলা ত্রিপুরা পুলিশ।
গত ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ মিজোরাম রাজধানী আইজল ও লুংলেই এলাকায় অভিযানে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র গোলাবারুদ উদ্ধার করে যা মিজোরামে স্মরণ কালের সবচেয়ে অস্ত্রে বড় চালান। সন্তু লারমার বডিগার্ড সশস্ত্র কমান্ডার অনির্বাণ চাকমা ওরফে চাইনিজ রনি চাকমা প্রত্যৎ ও বিরেঙ চাকমাসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়। তারা সবাই সন্তু লারমার সশস্ত্র ক্যাডার হিসেবে পরিচিত।
এরপর ৪ জুন ২০২৫ সালের জুন মাসে খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলায় সংঘটিত একটি সংঘর্ষ, স্থানীয়ভাবে যেটিকে ‘ধর্মযুদ্ধ’ বলা হচ্ছে, সেখানে পরাজিত হয়ে জেএসএস (সন্তু) গ্রুপের অন্তত ১৩ জন সশস্ত্র সদস্য ভারতে পালিয়ে যায়। পরে তারা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলার হাঁপানিয়া হাসপাতালের আশপাশের এলাকায় গা-ঢাকা দিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছিল।
গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে ত্রিপুরা পুলিশ ওই ১৩ জনকে গ্রেফতার করে। তাদের দেহে গুলির চিহ্ন ও ধারালো অস্ত্রের আঘাত ছিল। সন্দেহ করা হচ্ছে, তারা পানছড়িতে সরাসরি সংঘর্ষে জড়িত ছিল এবং সেই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নেয়।
পরবর্তী সময়ে, ১৯ জুন ২০২৪, মিজোরামের লুংলেই জেলায় আসাম রাইফেলসের অভিযানে স্বপ্ন চাকমা ও পূণ্যসুর চাকমাকে গ্রেফতার করা হয়। অভিযানে প্রায় ১০.৪৩ কোটি রুপি মাদক উদ্ধার হয়। এই মাদকের মূল হোতা হিসেবে অভিযুক্ত জেএসএসের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক বিধায়ক চাকমা@ বিনয় কুমার ও মিথুল চাকমা বিশাল ওরফে মৃণাল পালিয়ে যায়।
আরও উদ্বেগজনকভাবে, ধলাই জেলার রইশ্যাবাড়ি সীমান্তে জেএসএস কেন্দ্রীয় সদস্য বুলবুল চাকমার কোটি টাকার বার্মিজ সিগারেট জব্দ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অভিযোগ রয়েছে, তিনি জেএসএস কেন্দ্রীয় ফিল্ড কমান্ডার প্রণতি বিকাশ চাকমার ছেলে। এ ছাড়া গরু চোরাচালানেও সন্তু ক্যাডারদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।
সামাজিক মাধ্যমে ফেক আইডি ব্যবহার করে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য, ভারতে থেকে সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকা, এবং সম্প্রতি আগরতলা নাগিছড়ায় এক জেএসএস ক্যাডার মহিম চাকমা প্রাক্তন ব্যাংকার পরিবারকে হত্যাচেষ্টা- সব মিলিয়ে সংগঠনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ তীব্রতর হচ্ছে।
চাকমা গাবুজ্জে জোদা-র নেতারা বলেন, “চাকমা সমাজ এই অপরাধীদের আশ্রয় দেবে না। যারা জাতির মুখে কালিমা লাগায়, তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। ত্রিপুরার যুব সমাজ ভবিষ্যতে আরও বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলবে।”
বক্তারা ত্রিপুরা ও ভারত সরকারের কাছে অনুরোধ জানান, যেন সীমান্ত এলাকায় জেএসএস ক্যাডারদের অবৈধ অনুপ্রবেশ এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড রুখতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
সভার শেষে জেএসএস সন্তুপন্থীদের প্রতি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা হয়, এই অপকর্ম বন্ধ না হলে ত্রিপুরার মাটিতে তাদের আর ঠাঁই দেওয়া হবে না।
সম্প্রতি রাজ্যজুড়ে শুরু হয় সচেতনতা প্রচারণা
গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই ত্রিপুরার বিভিন্ন এলাকায় শিলাছড়ি,নতুন বাজার, করবুক, গন্ডাছড়া, পেঁচারতাল, আগরতলার নন্দননগর জেএসএস সন্তু গ্রুপের ভারতবিরোধী ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে দেয়ালে দেয়ালে পোস্টারিং ও লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে। এসব পোস্টারে সন্তু বাহিনীর বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা, অস্ত্র পাচার এবং চোরাচালানের অভিযোগ তোলা হয়।
এই পোস্টারিং ঘটনাগুলোর প্রেক্ষিতে আগতলার বিভিন্ন প্রথম সারির দৈনিক পত্রিকাও বিষয়টি গুরুত্বসহকারে প্রকাশ করেছে, যা রাজ্যজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।